পীরের নিকট কেন বায়াত হইতে হইবে?

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।
আল্লাহ পাক কোরআনুল করীমে সুরা বাকারা ১৩২ নং আয়াতে এরশাদ করেছেনঃ ফালাতামতুন্না ইল্লা ওয়া আনতুম মোসলেমুন। অর্থঃ তোমরা মোসলমান না হয়ে কবরে আসিও না। এখানে প্রশ্নঃ আমরা তো মোসলমান আছি। আল্লাহপাক আবার মোসলমান হওয়ার কথা কেন বলেছেন? আল্লাহ পাক কেন আবার মোসলমান হওয়ার কথা বলেছেন, তা দেখুন। যেমন আমার বাবা মোসলমান, আমিও মোসলমান। আমার বাবা যদি হিন্দু থাকতেন, তাহলে আমিও হিন্দু থাকতাম। আবার আমার বাবা যদি খৃষ্টান থাকতেন, তাহলে আমিও খৃষ্টান থাকতাম। আমার বাবা যদি বৌদ্ধ থাকতেন, তাহলে আমিও বৌদ্ধ থাকতাম। আমরা বাবার সাইনবোর্ড কাঁধে ঝুলিয়ে মোসলমান দাবী করিতেছি। যে বা যারা হিন্দু, বৌদ্ধ,খৃষ্টান থেকে মোসলমান হয় তারা দাবী করতে পারে তারা মোসলমান। আমরা মোসলমান বলে দাবী করি বাবার সাইন বোর্ড কাধে নিয়ে। এই জন্য আল্লাহপাক বলেছেনঃ তোমরা মোসলমান না হয়ে কবরে আসিও না। তাই আমাদেরকেক নতুন করে মোসলমান হতে হবে। নতুন করে মোসলমান হতে হলে আমাদের কি করতে হবে? আমাদেরকে কামেল মুর্শিদের হাতে বায়াত গ্রহণ করতে হবে। বায়াত গ্রহণ করলেই আমরা তখন মোসলমান বলে দাবী করতে পারবো। কারণ কামেল মুর্শিদের হাত, রাসুলের হাত, রাসুলে হাত, আল্লাহ পাকের হাত। "ফানাফিস শায়েখ, ফানাফির রাসুল, ফানাফিল্লাহ।" অর্থাৎ মুর্শিদের সাথে মিশলে রাসুলের সাথে মেশা হলো। রাসুলের সাথে মিশলে আল্লাহর সাথে মিশা হলো। কারণ মানুষের মৃত্যু তিনবার। প্রথমবার যখন সে ঘুম আসে। এটা হলো ছোট মৃত্যু। দ্বিতীয়বার হলো যখন সে পীরের নিকট মুরিদ হয়। মুরিদ অর্থ মরা, আত্মসমর্পণ করা। তৃতীয় মৃত্যু হলো যখন তার জান কবজ করা হয়। যখন লোক পীরের নিকট বায়াত গ্রহণ করে তখন সে নতুন মুসলমান হলো। এই সমন্ধে হযরত খাজা শাহ্ পীর চিশতী কেবলা (রহঃ) তার লিখিত কিতাব চিশতী উদ্যান শরীফে বলেছেনঃ মরনের আগে যাও মরিয়ে যদি সে থাকে ভয় মরণের। হাদীস শরীফে আছেঃ মুতু কাবলা আনতা মুতু। অর্থাৎ মরণের আগে মরে যাও। এই জন্যই আল্লাহ পাক বলেছেনঃ "তোমরা মোসলমান না হয়ে কবরে আসিও না।" পীরের নিকট বায়াত গ্রহণ করলেই সে নতুন করে মুসলমান হয়ে গেল। তখন কবরে গেলে কোন ভয় থাকবে না। কারণ আল্লাহ পাকের হুকুম পালন করা হলো। আল্লাহ পাকের হুকুম হলো ফরয।

বায়াত বা তরীকা গ্রহণ কোরআন শরীফ ও হাদীস শরীফ দ্বারা প্রমাণঃ
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।
বায়াত সমন্ধে কোরআন শরীফে  কি উল্লেখ করা আছে?

১. আয়াতঃ "লাক্কাদ রাদি আল্লাহু আনিল মুমেনিনা এজইউবা ইউনাকা তাহতাস সাজারাতে ফা আলেমা মাফি কুলুবিহিম ফাআন জালাচ্ছাকিনাতা আলাইহিম ওয়া আছাবাহুম ফাতাহান কারিবা।" [সুরা ফাতাহ আয়াতঃ ১৮। পারাঃ ২৬]
অর্থঃ নিশ্চয়ই আল্লাহ মুসলমানদের প্রতি সন্ত্তুষ্ট হয়েছিলেন যখন তারা নবী (সাঃ) এর হস্তে গাছের নীচে বায়াত গ্রহণ করেছিল। ফলতঃ তিনি তাদের অন্তঃকরণে যে সততা ও কৃতজ্ঞতা বিরাজ করেছিল তা অবগত হয়েছেন। অতঃপর তাদের প্রতি তিনি শান্তি অবতরণ করেছেন এবং তাদেরকে শীঘ্রই বিজয় দানে পুরস্কৃত করেছেন।

২. আয়াতঃ "ইয়া আইয়োহাল্লাজিনা আমানোত্তাকুল্লাহা ওয়াবতাগু ইলাইহিল ওয়াছিলাতা ওয়া জাহেদু ফি ছাবিলিল্লাহি লায়াল্লাকুম তুফলেহুন।" [সুরা মায়েদা আয়াতঃ৩৫। পারাঃ ৬]
অর্থঃ হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় করতে থাকো এবং আল্লাহকে চেনার জন্য ওছিলা খোঁজ কর এবং আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ কর। এতেই তোমাদের সাফল্য।

৩. আয়াতঃ "ইন্নাল্লাজিনা ইউবায়িওনাকা ইন্নামা ইউবায়িউনাল্লাহা ইয়াদুল্লাহে ফাউকা আইদিহিম।" [সুরাঃ ফাতাহ আয়াতঃ১০। পারা ২৬]
অর্থঃ নবী(সাঃ)-কে উদ্দেশ্য করে বলা হচ্ছেঃ যাঁরা আপনার হাতে হাত দিয়ে বায়াত হয়েছে, হে রাসুল, অবশ্যই তারা আল্লাহর হাতে হাত দিয়ে বায়াত গ্রহণ করেছে। তাদের হাতের উপর আল্লাহর হাত।

৪. আয়াতঃ " মাই ইউতের রাসুলা ফাক্কাদ আতা আল্লাহা " । [সুরাঃ নেসা আয়াতঃ ৮০। পারা ৫]
অর্থঃ আল্লাহ ঘোষণা করছেনঃ যে ব্যক্তি রাসুলের আনুগত্য করলো সে অবশ্যই আমার (আল্লাহর) আনুগত্য করলো।

৫.আয়াতঃ "কুল ইনকুনতুম তুহিব্বুনাল্লাহে ফাত্তাবেউনি ইউবিকুমুল্লাহ।" [সুরা আলে ইমরান আয়াতঃ৩১। পারা ৩]
অর্থঃ আল্লাহ পাক বলেছেনঃ তোমরা যদি আমাকে ভালোবাসতে চাও তবে আমার নবীকে ভালবাসো। নবীকে ভালোবাসলেই আমাকে ভালোবাসা হবে।

৬. আয়াতঃ " ওয়া আতিউল্লাহা ওয়া আতিউর রাসুলা ওয়া উলিল আমরি মিনকুম।" [সুরা নিসা আয়াতঃ৫৯]
অর্থঃ আনুগত্য কর আল্লাহর, আনুগত্য কর রাসুলের এবং তাঁর প্রতিনিধির।

মহিলাদিগকে বায়াত করার দলিলঃ
আয়াতঃ " ফাবায়হুন্না আস্ তাগফেরলা হুন্নাল্লাহা ।" [সুরা মোমতাহেনা আয়াতঃ ১২]
অর্থঃ হে নবী আপনি মহিলাদিগকে বায়াত করুন এবং তাদের নিকট হতে অঙ্গিকার নিন।

হাদিছ শরীফে আছেঃ "আহেব্বুনী লেহুবিল্লাহে ওয়া আহেব্বু আহলে বাইয়াতি লেহুব্বি।" অর্থঃ আল্লাহর জন্য আমার সাথে মুহাব্বত রাখো। আমার মুহাব্বতের খাতিরে আমার আহলে বায়াতের সাথে মুহাব্বত রাখো।

সুতরাং এ থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, বায়াত গ্রহণ করা একান্ত প্রয়োজন। কেননা, ওছিলা বলতে পীর মুর্শিদগণকেই বুঝানো হয়েছে। অথচ কেমন করে কিছু সংখ্যক লোক বলেন যে, পীরের দরকার নেই?

বায়াত সমন্ধে হযরত রাসুলুল্লাহ সাল্লালল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেনঃ
১. "তোমাদের মধ্যে আমার আহলে বাইয়াতের দৃষ্টান্ত নুহ (আঃ)-এর কিস্তির ন্যায়। যারা ওটাতে চড়েছিল, তাঁরা নাজাত পেয়েছিল। আর যাঁরা চড়ে নাই তারা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।"

২. "যাঁরা আমার ও আমার ছাহাবাগণকে অনুস্বরণ করবে, তারাই নাজাতী দল।"

৩. "আমার ছাহাবাগণ তারকা সাদৃশ্য। তোমরা যে কোন একজনকে অনুস্বরণ করলে হেদায়েতপ্রাপ্ত হবে।"

৪. এছাড়া হাদীছে কুদছিতে আছেঃ "আশ শায়খু কাওমেহি, কান নাবীও উম্মতিহী"। অর্থঃ উম্মতগণের মধ্যে নবীর যে ভুমিকা, মুরীদের মধ্যে পীরদের সেই ভুমিকা। "আল উলামাও উম্মতি কান নাবীও বণি ইশরাইলা।" অর্থঃ আমার আলেম উম্মতগণ বণী ইসরাইলদের নবী সাদৃশ্য।

বায়াত সমন্ধে সীরাতুন নবী কিতাবের ৫৩০ পৃষ্ঠা হতে ৫৩১ পৃষ্ঠায় বর্ণিত আছেঃ সাফা পার্বত্য এলাকার এক উঁচু জায়গায় রাসুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম বসতেন। যাঁরা ইসলাম গ্রহণ করতে আসতো, তাঁরা হাতে হাত রেখে বাইয়াত গ্রহণ করতো। পুরুষদের পালা শেষ হলে স্ত্রী লোকেরা আসতো। স্ত্রীলোকদের বাইয়াত করবার পদ্ধতি ছিল এই যে, তাঁদের নিকট হতে ইসলামের আরকান সমুহ (ইসলামের আরকান বলতে ইসলামের পন্ঞ্চ স্তম্ভ কলেমা, নামায, রোজা, হজ্জ ও যাকাতকে বুঝায়) এবং সতীত্ব ও চরিত্র রক্ষার শপথ নিতেন। অতঃপর হযরত (সাঃ) পানিপুর্ণ একটি পেয়ালার মধ্যে তার পবিত্র হস্ত মোবারক ডুবিয়ে নিতেন। অতঃপর স্ত্রী লোকেরা তাঁদের হাত সেই পানিতে ডুবাতেন। এভাবে  তাদের বাইয়াত করাতেন।

বায়াত সমন্ধে বোরহানুল আশেকীন কিতাবের ১৬-১৮পৃষ্ঠায় হযরত খাজা শাহ্ পীর চিশতী নিজামী বান্দানেওয়াজী (রহঃ) লিখেছেনঃ "অানা মদীনাতুল এলমে ওয়া আলী বাবুহা"। অর্থঃ আমি এলমের শহর আর আলী ঐ শহরের প্রবেশ করিবার দরওয়াজা। হিজরী নবম বৎসরে আখেরী হজ্জের (হজ্জ্বাতুল বেদা) পর পুণ্যভুমি মক্কা নগরী হইতে মদিনা শরীফের পথিমধ্যে খুমে গাদির নামীয় স্থানে যখন হযরত রসুলে আকরাম (দঃ) সকল ছাহাবিগণের সম্মুখে প্রদত্ত খোৎবা পাঠ করিয়া প্রকাশ করিলেন যে তিনি তাহাদের মধ্যে চিরকাল থাকিবেন না এবং তাহার পরলোকগমণ নিকটবর্তী। তখন ছাহাবিগণ বিব্রত ও হতভম্ভ হইয়া জিগ্যাসা করিলেন, "ইয়া রছুলুল্লাহ, আপনার পরে আমাদের হেদায়েতের কি উপায় হইবে?" ইহার উত্তরে হযরত রছুলে আকরাম (দঃ) নিম্নোক্ত হাদীছ শরীফটি বয়ান করিলেনঃ  আমি তোমাদের মধ্যে দুইটি ভারী বস্ত্তু ছাড়িয়া যাইতেছি, উহার প্রথমটি আল্লার কেতাব যাঁহার ভিতরে নুর ও হেদায়েত আছে। আল্লাহর কেতাবকে দৃঢ়ভাবে ধর এবং দ্বিতীয়টি আমার "আহলে বায়াত" (পরিবারবর্গ) আমার আহলে বায়াত সমন্ধে তোমাদিগকে স্বরণ করাইতেছি। এইরুপ তিনবার বলিলেন। অর্থাৎ খোদাকে সাক্ষ্য করিয়া তোমাদিগকে আহলে বায়াতের কথা বলিতেছি। এই উভয় বস্তুকে যাহারা অনুস্বরণ করিবে তাহারাই হেদায়েত (দিনের পথ) এবং যাহারা পরিত্যাগ করিবে তাহারা গোমরাহ (পথভ্রষ্ট) হইবে।
প্রিয় পাঠক! কোরান শরীফ আল্লাহ তায়ালার আহকাম (আদেশাবলী) পাইবার জন্য প্রধান বস্তু এবং ইহার উপরই শরীয়তের ভিত্তি। আর আহলে বায়ত আল্লাহতায়ালার নুর পাইবার প্রধান ওছিলা ও উপায়-এবং তাঁহাদের দ্বারা তরীকতের সৃষ্টি। আরশে এই নুরের নাম বেলায়েত যাহা রসুলুল্লাহ (দঃ) প্রথম নবুয়ত প্রাপ্তি ও কোরান নাজিলের সময় ওহী বাহক হযরত জিব্রাইলের ছিনা হইতে প্রাপ্ত হন। ইহা মাওলানা শাহ্ আবদুল আজিজ মহাদ্দেছে দেহলবীর তফছীরে আজিজীতে "একরা বেছমে" তফছীরে ও ছহি হাদীছে বর্ণিত আছে।  হযরতের আহলে বায়ত মধ্যে হযরত আলী (কঃ) হযরত ইমাম হাসান (রাঃ) হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) এবং বিবি ফাতিমা জোহরা (রাঃ)। এই আহলে বায়তের ভিতর হযরত আলীই (কঃ) প্রধান। তিনি সেই নুরে এলাহীর "বেরঅয়েত" হযরত রসুলে আকরাম (দঃ) হইতে প্রাপ্ত হন। এবং সেই সময় হইতে "বেলায়েত" তাঁহার বংশধর ও অন্যান্য খলিফাদের দ্বারা এ পর্যন্ত সিনায় সিনায় ক্রমশঃ ছেলছেলাওয়ারী চলিয়া আসিতেছে। হযরত ইমাম আবু হানিফা (রাঃ) হযরত ইমাম জাফর ছাদেক (রাঃ) এর হস্তে মুরিদ হইয়া নুরমুহম্মদী অর্থাৎ "বেলায়েত" হাছেল করিয়াছিলেন। হযরত ইমাম আহম্মদ হাম্বল (রাঃ) ছাহেব হযরত বশর হাফি (রাঃ) ও হযরত ছিররী-ছাকতি (রাঃ) ও হযরত মারুফকারখী ছাহেবানকে ক্রমে মোরশেদ ধরিয়া মুরিদ হইয়াছিলেন।
(ক্রমশঃ)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন